![]() |
১ম পর্ব |
বিজ্ঞান একাডেমির মহাপরিচালক মহামান্য কিহি কালাে গ্রানাইট টেবিলের চারপাশে বসে থাকা অন্য সদস্যদের মুখের দিকে একনজর তাকিয়ে নরম গলায় বললেন, ‘অনেক দিন পর আজ আমি তােমাদের সবাইকে আমার এখানে ডেকে এনেছি৷ আমার ডাক শুনে তােমরা সবাই এসেছ, সে জন্য অনেক ধন্যবাদ৷ একাডেমির তরুণ সদস্য ফিদা তার মাথার সােনালি চুল হাত দিয়ে পেছনে সরিয়ে বলল, “মহামান্য কিহি, আপনি আমাদের ডেকেছেন, এটি আমাদের কত বড় সৌভাগ্য৷ অন্য সবাই মাথা নেড়ে সায় দিল, বলল, “অনেক বড় সৌভাগ্য৷
মহামান্য কিহি মৃদু হেসে বললেন, “অনেক বয়স হয়েছে, কখন পৃথিবী থেকে চলে যেতে হয়, তাই ভাবলাম, একবার তােমাদের সবার সঙ্গে বসি৷ একটু খােলামেলা কথা বলি৷ জীববিজ্ঞানী রিকি মাথা নেড়ে বলল, “আপনাকে আমরা এত সহজে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে দেব না৷
আপনি আরও অনেক দিন আমাদের সঙ্গে থাকবেন৷ অন্যরাও মাথা নাড়ল, গণিতবিদ টুহাস সােজা হয়ে বসে বলল, “মহামান্য কিহি, আপনি পৃথিবীর ইতিহাসে বিজ্ঞান একাডেমির সর্বশ্রেষ্ঠ মহাপরিচালক৷
আপনার সময় এই পৃথিবী সব দিক দিয়ে সর্বশ্রেষ্ঠ জায়গায় পৌঁছেছে৷ বিজ্ঞানী ফিদা মাথাটা সামনে এগিয়ে এনে বলল, “হ্যা৷ এই মুহূর্তে পৃথিবী যে অবস্থায় পৌছেছে, আর কখনাে সে রকম অবস্থায় ছিল না৷ জ্ঞানে - বিজ্ঞানে, শিল্পে - সাহিত্যে সব দিক দিয়ে পৃথিবীর মানুষ একটা নতুন অবস্থায় পৌঁছেছে৷ গণিতবিদ টুহাস বলল, “এর পুরাে কৃতিত্ব আপনার৷ মহামান্য কিহি বাধা দিয়ে বললেন, “না, না, তােমরা তােমাদের কথায় অতিরঞ্জন করছ৷
এটা মােটেই আমার একক কৃতিত্ব নয়৷ আমি কখনােই একা কোনাে সিদ্ধান্ত নিইনি৷ তােমাদের সবার সঙ্গে কথা বলেছি, কথা বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি৷ কাজেই যদি কোনাে কৃতিত্ব থাকে তাহলে সেটা আমার একার নয়, আমাদের সবার৷ বিজ্ঞানী ফিদা বলল, “কিন্তু নেতৃত্বটুকু দিয়েছেন আপনি৷ মহামান্য কিহি বললেন, যা - ই হােক, আমি এটা নিয়ে তােমাদের সঙ্গে তর্ক করতে চাই না৷
বরং তােমাদের কি জন্য ডেকেছি সেটা নিয়ে কথা বলি৷ সবাই মাথা নেড়ে সােজা হয়ে বসে উৎসুক চোখে মহামান্য কিহির দিকে তাকাল৷ মহামান্য কিহি খানিকটা অন্যমনস্কভাবে বললেন, “এটা তাে কেউ অস্বীকার করতে পারবে না যে মানুষ হচ্ছে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি৷ হােমাে স্যাপিয়েনস এই পর্যায়ে এসেছে বিবর্তনের ভেতর দিয়ে, তার জন্য সময় লেগেছে লাখ লাখ বছর৷
সেই দুই শ হাজার বছর আগের হােমাে স্যাপিয়েনস বিবর্তনের ভেতর দিয়ে বর্তমান পর্যায়ে এসেছে৷ এই বিবর্তনটুকু পুরােপুরি এসেছে প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রভাবে, স্বাভাবিকভাবে৷ মহামান্য কিহি একটু থামলেন, তিনি ঠিক কী বলতে চাইছেন বােঝার জন্য সবাই আগ্রহ নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল৷ মহামান্য কিহি আবার শুরু করলেন, বললেন, ‘এ মুহূর্তে এই পৃথিবীতে মানব প্রজাতি তাদের সর্বশ্রেষ্ঠ অবস্থায় আছে৷ আমরা কি জানি, আজ থেকে এক লাখ বছর পর কিংবা এক মিলিয়ন বছর পর আমরা কোন পর্যায়ে থাকব?
আমরা কি আমাদের মতােই থাকব, নাকি অন্য রকম হয়ে যাব? জীববিজ্ঞানী টুহাস বলল, “আমরা সিমুলেশন করে সেটা দেখেছি ... মহামান্য কিহি মাথা নাড়লেন, বললেন, হ্যা, আমি সেই সিমুলেশন দেখেছি৷ তােমরাও দেখেছ৷ আমি দেখে একটু দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়েছি এবং সে জন্যই আমি তােমাদের ডেকেছি৷ মহামান্য কিহি একটু থামলেন৷
সবার চোখের দিকে তাকালেন এবং বললেন, ‘মানুষ প্রকৃতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বিবর্তনের ভেতর দিয়ে এখানে এসেছে, কিন্তু এখন বিজ্ঞানের মহিমায় আমাদের আর বিবর্তনের ওপর নির্ভর করতে হয়৷ মানুষের ভেতরে যদি কোনাে পরিবর্তন আনতে হয়, আমরা ইচ্ছে করলে সেটা আনতে পারি৷ জীববিজ্ঞানী টুহাস বলল, “মহামান্য কিহি, আপনি কি বলতে চাইছেন আমরা নিজে থেকে মানুষের ভেতরে কোনাে পরিবর্তন আনি?
“আমি সেটা সেভাবে বলতে চাইছি না৷ আমি তােমাদের কাছে জানতে চাইছি৷ বিজ্ঞান একাডেমির সদস্য হিসেবে এই পৃথিবীর মানবজাতির পুরাে দায়িত্ব আমাদের হাতে৷ ভবিষ্যতের মানুষ এই পৃথিবীতে কীভাবে থাকবে, সেটা নির্ভর করে বর্তমানের মানুষকে আমরা কীভাবে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করি৷ আমি তােমাদের কাছে জানতে চাইছি, পৃথিবীর মানুষ কি ভবিষ্যতের জন্য পুরােপুরি প্রস্তুত? মানবদেহ কি নিখুঁত?
হঠাৎ করে সবাই একসঙ্গে কথা বলতে শুরু করল, আবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সবাই চুপ করে গেল৷ জীববিজ্ঞানী টুহাস বলল, “না, মহামান্য কিহি, মানবদেহ নিখুঁত নয়৷ এর মধ্যে অনেক ত্রুটি আছে৷ আমরা সবাই সেটা জানি৷ বিবর্তনের কারণে আমাদের চোখটা ভুল, চোখের ভেতরে আলাে - সংবেদন কোষ নিচে, নার্ভ ওপরে৷ অক্টোপাসের চোখ হচ্ছে সঠিক৷ বিজ্ঞানী ফিদা বলল, তুমি চোখের কথা বলছ, কিন্তু আমরা তাে সাধারণত চোখের সীমাবদ্ধতাটা দৈনন্দিন জীবনে টের পাই না৷ যেটা টের পাই সেটার কথা বলাে না কেন?
‘সেটা কী? নবজাতকের মাথা৷ তুমি জানাে, মানবশিশুর মাথা কত বড়? একজন মায়ের গর্ভনালি দিয়ে মানবশিশু বের হতে পারে না, মায়ের সন্তান জন্ম দিতে কত কষ্ট হয়, তুমি জানাে? জীববিজ্ঞানী টুহাস বলল, ‘আমি পুরুষ মানুষ, সন্তান জন্ম দিতে হয় না৷ তাই কষ্টের পরিমাণটুকু জানি না৷ কিন্তু বিষয়টি আমি বুঝতে পারছি৷
গণিতবিদ রিকি বলল, “বিবর্তনের কারণে মানুষ হঠাৎ করে দুই পায়ে দাঁড়িয়ে গেছে, কিন্তু হাড়ের সংযােগটা মানুষের পুরাে ওজন ঠিকভাবে নিতে পারে না৷ দুটি পা না হয়ে চারটি পা হলে ওজনটা ঠিকভাবে নিতে পারত৷ মানুষের হাঁটুও খুব দুর্বল৷ প্রযুক্তিবিদ রিভিক কম কথা বলে, সে সবাইকে বাধা দিয়ে বলল, “তােমরা কেউ এপেনডিক্সের কথা কেন বলছ না? এটা শরীরের কোনাে কাজে লাগে না৷ হঠাৎ হঠাৎ সংক্রমিত হয়ে কী ঝামেলা করে দেখেছ? রিভিকের কথার ভঙ্গিতে সবাই হেসে উঠল৷
জীববিজ্ঞানী সুহাস বলল, এটা ঝামেলা দিতে পারে, কিন্তু এর গুরুত্ব কম৷ এর চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে পুরুষ ও নারীর জননেন্দ্রিয় এবং এগুলাে কোনােভাবেই সঠিক নয়৷ এর অবস্থান খুবই বিপজ্জনক! বিজ্ঞানী ফিদা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল৷ মহামান্য কিহি হাত তুলে সবাইকে থামিয়ে দিলেন৷
মৃদু হেসে বললেন, “আমি জানি, মানবদেহের ডিজাইনের অসম্পূর্ণতা নিয়ে তােমাদের সবারই অনেক কিছু বলার আছে! আমরা ইচ্ছে করলে এটা নিয়ে সারা দিন কথা বলতে পারি৷ কিন্তু আমি সেটা করতে চাইছি না৷ আমাদের কেন্দ্রীয় কম্পিউটারে মানবদেহের সীমাবদ্ধতার পুরাে তালিকা রয়েছে৷ তােমরা এখন যা যা বলেছ, তার বাইরে আরও অনেক বিষয় আছে৷ আমি তােমাদের কাছে জানতে চাইছি, আমরা কি প্রাকৃতিক বিবর্তনের ওপর ভরসা করে অপেক্ষায় থাকব, নাকি আমরা নিজেরা মানবদেহের সীমাবদ্ধতাগুলাে মিটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব?
বিজ্ঞান একাডেমির সদস্যরা আবার সবাই একসঙ্গে কথা বলতে শুরু করল৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা অবশ্য থেমে গেল৷ তারপর একজন একজন করে নিজের বক্তব্য বলল৷ দীর্ঘ আলােচনার পর বিজ্ঞান একাডেমি থেকে মানবজাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে সর্বকালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটি নেওয়া হলাে৷ বিজ্ঞান একাডেমি সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নিল, মানবজাতির জেনােমে আগামী এক শ বছরে খুব ধীরে ধীরে পরিবর্তন আনা হবে, যেন এক শ বছর পর মানবদেহে আর কোনাে সীমাবদ্ধতা না থাকে৷
মানবদেহ হবে নিখুঁত, যেন তারা ভবিষ্যতে এই পৃথিবীতে অত্যন্ত সফল একটা প্রজাতি হিসেবে টিকে থাকতে পারে৷ সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর মহামান্য কিহি নরম গলায় বললেন, তােমাদের সবাইকে ধন্যবাদ৷ ভবিষ্যতের মানব আজকের এই সিদ্ধান্তের জন্য তােমাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে৷ সবাই মাথা নাড়ল, বিজ্ঞানী ফিদা বলল, আপনার নেতৃত্ব ছাড়া আমরা কখনােই এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম না, মহামান্য কিহি৷
চলবে........
মুহাম্মদ জাফর ইকবাল এর বই থেকে নেওয়া অক্টোপাসের চোখ
কোন প্রশ্ন বা মন্তব্য থাকলে করতে পারেন৷
Related
ডেঞ্জারাস গার্ল আর নরকের শয়তান
Thanks to comment Jibon Somossa official blog. Stay with us for more content. Follow us to Facebook. www.facebook.com/jibonsomossa.blog