বিজ্ঞান একাডেমির মহাপরিচালকের সামনে রাষ্ট্রীয় চিকিৎসাকেন্দ্রের পরিচালক মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল৷ পরিচালক মাথা তুলে বলল, ‘এটি আপনি কী বলছেন, মহামান্য কিহি? ‘আমি এটা ঠিকই বলছি৷ আমি অনেক চিন্তা করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি৷ মহামান্য কিহি বললেন, “তুমি প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করাে৷ চিকিৎসাকেন্দ্রের পরিচালক বলল, “আপনার দেহ সুস্থ ও নিরােগ৷ আপনি আরও দীর্ঘদিন বেঁচে থাকবেন৷ আপনি কেন এখনই শীতল ঘরে যেতে চাইছেন?” মহামান্য কিহি বললেন, “তার দুটি কারণ৷
প্রথমত, আমি নতুন নেতৃত্ব গড়ে তুলতে চাই৷ আমি দীর্ঘদিন বিজ্ঞান একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছি৷ এখন অন্য কেউ করুক৷ দ্বিতীয়ত, আমি খুব বেশি বৃদ্ধ হয়ে অচল হওয়ার আগেই শীতল ঘরে যেতে চাই৷ আজ থেকে এক শ বছর পর আমি জেগে উঠে পৃথিবীর মানুষকে দেখতে চাই৷ মানবদেহের সব সম্পূর্ণতা আর ত্রুটি দূর করার পর তারা পৃথিবীতে কীভাবে বসবাস করবে, আমি সেটা নিজের চোখে দেখতে চাই৷ চিকিৎসাকেন্দ্রের পরিচালক বিষন্ন গলায় বলল, “আপনি যদি সেটাই চান, তাহলে আমরা সেটাই করব৷
তবে, মহামান্য কিহি, পৃথিবীর মানুষ কিন্তু আপনাকে এভাবে হারাতে চাইবে না৷' মহামান্য কিহি মৃদু হেসে বললেন, “তুমি সেটা নিয়ে মাথা ঘামিয়াে না৷ আমাকে একটা শীতল ঘরে রাখার ব্যবস্থা করাে৷ আমাকে জাগিয়ে তুলবে আজ থেকে ঠিক এক শ বছর পর৷ চিকিৎসাকেন্দ্রের পরিচালক মাথা নুইয়ে বলল, “আপনার আদেশ আমাদের সবার জন্য শিরােধার্য৷ ক্যাপসুলের ভেতর খুব ধীরে ধীরে চোখ খুললেন মহামান্য কিহি৷
ভেতরে আবছা ও নীলাভ এক ধরনের আলাে৷ মাথার কাছে কোনাে একটা পাের্ট থেকে শীতল বাতাস বইছে৷ সেই বাতাসে এক ধরনের মিষ্টি গন্ধ৷ চোখের কাছাকাছি একটা প্যানেল৷ সেখানে সবুজ আলাের একটা সংকেত৷ ছােট মিটারটি দেখাচ্ছে, পৃথিবীতে এর মধ্যে একশ বছর কেটে গেছে৷ মহামান্য কিহি শান্ত হয়ে শুয়ে রইলেন, তাঁর শরীরের অঙ্গ - প্রত্যঙ্গ কিছুক্ষণের মধ্যেই সচল হয়ে উঠবে৷ তখন তিনি এই ক্যাপসুলের ভেতর থেকে বের হয়ে আসবেন৷
তিনি নিজের ভেতরে এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করতে থাকেন৷ মহামান্য কিহি যখন ক্যাপসুল খুলে বের হয়ে এলেন তখন পৃথিবীতে সূর্য ঢলে পড়ে বিকেল নেমে এসেছে৷ তিনি সুরক্ষিত ঘরের ভারী দরজা খুলে বের হয়ে আসতেই বাইরের সতেজ সবুজ পৃথিবীর ঘ্রাণ অনুভব করলেন৷ চারপাশে বড় বড় গাছ, ঘাস উঁচু হয়ে আছে, ওপরের নীল আকাশে সাদা মেঘ৷ তিনি কান পেতে পাখির কিচিরমিচির শব্দ শুনতে পেলেন৷ বুকের ভেতর তিনি এক ধরনের প্রশান্তি অনুভব করলেন৷
ফিসফিস করে নিজের মনে বললেন, “আহা! এই পৃথিবী কী অপূর্ব সৃষ্টিকর্তা, তােমাকে ধন্যবাদ, আমাকে মানুষ হিসেবে এই পৃথিবীতে পাঠানাের জন্য! মহামান্য কিহি ঘাসের ওপর পা দিয়ে সামনে হেঁটে যেতে থাকেন৷ তাঁকে একটা লােকালয়, একটা জনপদ খুঁজে বের করতে হবে৷ পৃথিবীর পূর্ণাঙ্গ মানুষকে নিজের চোখে দেখতে হবে৷ তার কৌতূহল আর বাধ মানতে চাইছে না৷ হঠাৎ মহামান্য কিহি এক ধরনের সতর্কশব্দ শুনে মাথা ঘুরিয়ে তাকালেন৷ খানিকটা দূরে কয়েকটি চতুস্পদ প্রাণী তাদের চার পায়ের ওপর ভর করে তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে৷
কী বিচিত্র এই প্রাণীটি, আর কী বিচিত্র তার দৃষ্টি! তাঁর সময় কখনাে তিনি এ ধরনের কোনাে প্রাণী দেখেননি৷ প্রাণীগুলাে এক ধরনের হিংস্র শব্দ করতে করতে হঠাৎ চার পায়ে ভর করে তাঁর দিকে এগিয়ে আসতে থাকে এবং হঠাৎ করে তিনি বুঝতে পারেন, এগুলাে আসলে মানুষ৷ ভয়াবহ আতঙ্কের একটা শীতল স্রোত তার মেরুদণ্ড দিয়ে বয়ে যায়৷ তার ভবিষ্যতের মানুষের এটি কোন ধরনের পরিণাম? মানুষগুলাে একটু কাছে এলে তিনি বুঝতে পারেন, মায়েদের সন্তান জন্ন দেওয়ার কষ্ট লাঘব করার জন্য এদের মাথা ছােট করে দেওয়া হয়েছিল৷
সে জন্য মস্তিষ্কের আকারও ছােট হয়েছে৷ এখন তারা আর বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ নয়৷ তারা এখন বুদ্ধিবৃত্তিহীন পশু৷ তারা সবাই উলঙ্গ, কাপড় পরার প্রয়ােজনীয়তাটুকু পর্যন্ত অনুভব করে না৷ শরীরের ওজন সঠিকভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তারা এখন চার হাত পায়ে ছােটাছুটি করে৷ বিবর্তনে মানুষ একবার দুই পায়ে দাঁড়িয়েছিল৷ এখন উল্টো বিবর্তনে আবার তারা চার পায়ে ফিরে গেছে৷ মহামান্য কিহি এই মানুষগুলাের দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকেন৷
তাদের ভেতরে আরও অনেক সূক্ষ্ম পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু সেগুলাে বােঝার আগেই মানুষগুলাে তাকে ধরে ফেলল, হাতগুলাে এখনাে ব্যবহার করতে পারে৷ শক্ত হাতে তাকে ধরে ফেলে হিংস্র শব্দ করতে করতে দাঁত দিয়ে কামড়ে তার কণ্ঠনালি ছিড়ে ফেলল৷ মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে তিনি তাদের চোখের দিকে একবার তাকাতে পেরেছিলেন, বােধহীন পশুর হিংস্র চোখ, কিন্তু সেগুলাে ছিল নিখুঁত অক্টোপাসের চোখ৷
মুহাম্মদ জাফর ইকবাল এর বই থেকে নেওয়া অক্টোপাসের চোখ
কোন প্রশ্ন বা মন্তব্য থাকলে করতে পারেন৷
Related
Thanks to comment Jibon Somossa official blog. Stay with us for more content. Follow us to Facebook. www.facebook.com/jibonsomossa.blog